বিশ্বগ্রামের ধারণা (Concept of Global Village):
Village বা গ্রাম হলো একটি ছোট গোষ্ঠী অথবা কতগুলো বাড়ির সমষ্টি । নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত আয়তনে একটি গ্রামের অবস্থান বিধায় গ্রামে বসবাসকারীরা সবাই সবাইকে চিনে । গ্রামে কোনো তথ্য প্রকাশিত হলে মুহূর্তেই তা মুখে মুখে জানাজানি হয়ে যায় । গ্রামে যে কোনো মুহূর্তে একজন আরেকজনকে কাজে সহযোগিতা করে থাকে ।
‘গ্লোবাল’ শব্দের অর্থ হলো বিশ্ব । গ্লোবাল ভিলেজ অর্থ বিশ্বগ্রাম । গ্লোবাল ভিলেজ (Global Village) হলো প্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ব যাতে বিশ্বের সবদেশ সবজাতি একটি গ্রামের মতো সুবিধা পায় ।
yourdictionary.com অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে – “The definition of a global village is the idea that people are connected by easy travel, mass media and electronic communications, and have become a single community.”
“গ্লোবাল ভিলেজ হলো একটি ধারণা যেখানে মানুষ সহজ যাতায়াত, গণমাধ্যম, ইলেক্ট্রনিক কমিউনিকেশন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত এবং একটি একক কমিউনিটিতে পরিণত হয় ।”
অক্সফোর্ড আমেরিকান ডিকশনারি অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে – “The world considered a single community linked by telecommunications.”
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়- বিশ্বগ্রাম (Global Village) হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর এমন একটি পরিবেশ যেখানে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করেও পৃথিবীর সকল মানুষ একটি একক সমাজে বসবাস করার সুবিধা পায় এবং একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে । অর্থাৎ গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে এমন একটি ধারণা ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীটাকেই একটি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
বিশ্বগ্রাম ধারণার প্রবর্তকঃ
কানাডিয়ান দার্শনিক ও লেখক হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান (Herbert Marshal McLuhan) হলেন প্রথম ব্যক্তি জিনি বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ শব্দটিকে সকলের সামনে তুলে ধরে একে জনপ্রিয় করে তোলেন । ১৯৬২ সালে তার প্রকাশিত ‘The Gutenberg Galaxy: The Making of Typographic Man’ এবং ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘Understanding Media: The Extensions of Man’ বইয়ের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রকাশ করেন ।
হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান (Herbert Marshal McLuhan) কানাডার অ্যাডমন্টন শহরে ২১ জুলাই ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন । ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি নিয়ে তিনি কলেজে শিক্ষকতা করেন । ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ম্যাকলুহান কমিউনিকেশন এবং কালচারের ওপর সেমিনার শুরু করেন । ম্যাকলুহানের বই ‘The Gutenberg Galaxy : The making of Typographic Man’ – এ বইয়ে ম্যাকলুহান দেখিয়েছেন কীভাবে কমিউনিকেশন টেকনোলোজি তথা আক্ষরিক লেখা, প্রিন্টিং প্রেস এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিভিন্ন দর্শনগত ভিত্তিকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কত গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে ।
বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার উপাদানসমূহ (Elements for Establishing Global Village):
বিশ্বগ্রামের প্রধান উপাদানসমূহ হলো-
- হার্ডওয়্যার (Hardware)
- সফটওয়্যার (Software)
- ইন্টারনেট সংযুক্ততা (Connectivity)
- ডেটা (Data)
- মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা (Capacity)
1. হার্ডওয়্যার (Hardware): বিশ্বগ্রামে যে কোনো ধরনের যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সর্বপ্রথম যেটি প্রয়োজন তা হলো উপযুক্ত হার্ডওয়্যার সামগ্রি । হার্ডওয়্যার বলতে এখানে বুঝায় কম্পিউটার আর এর সাথে যন্ত্রপাতি, মোবাইল ফোন, অডিও-ভিডিও রেকর্ডার, স্যাটেলাইট, রেডিও, টেলিভিশন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত ডিভাইসসমূহ ।
2. সফটওয়্যার (Software): বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠায় সফটওয়্যারের গুরুত্ব অপরিসীম । সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপারেটিং সিস্টেম, ব্রাউজিং সফটওয়্যার, কমিউনিকেটিং সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামিং ভাষা ।
3. ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেক্টিভিটি (Connectivity): বিশ্বগ্রামের মেরুদন্ড হলো নিরাপদভাবে রিসোর্স শেয়ার করার ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেক্টিভিটি, যার মাধ্যমে বিভিন্ন উপাত্ত ও তথ্য ব্যবহারকারীর নিকট পৌঁছে । নিরাপদ তথ্য আদান- প্রদানই হচ্ছে বিশ্বগ্রামের মূলভিত্তি । এক্ষেত্রে টেলিকমিউনিকেশন, ব্রডকাস্টিং এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেট কানেকশন দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে ।
4. ডেটা (Data): ডেটা হচ্ছে Fact বা Item যা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে । বিশ্বগ্রামে বিভিন্ন তথ্য যা ডেটা থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করে পাওয়া যায় । বিশ্বগ্রামে ডেটা ও তথ্যকে মানুষ তার প্রয়োজনে একে অপরের সাথে বিনামূল্যে বা অরথের বিনিময়ে শেয়ার করতে পারে । তবে এক্ষেত্রে যথাযথ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তথ্য ভান্ডারে সংরক্ষিত ডেটা ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে ।
5. মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা (Capacity): বিশ্বগ্রামের উপাদানগুলোর মধ্যে ব্যবহারকারীর জ্ঞান বা সক্ষমতা অন্যতম । বিশ্বগ্রাম মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর । তাই মানুষের সচেতনতা ও সক্ষমতার ওপর এর সুফল নির্ভর করছে ।
গ্লোবাল ভিলেজের সুবিধাসমূহ (Advantages of Global Village):
- মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যে কোনো স্থানের যে কোনো ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা যায় ।
- দূরত্ব অনুভূত হয় না অর্থাৎ ভৌগলিক দূরত্ব কমে যায় ।
- ব্যবস্থাপনা খরচ কমে ।
- অন-লাইনে যেকোনো লাইব্রেরি থেকে বই পড়া যায় এবং ঘরে বসেই বিশ্বের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা গ্রহন করা যায় ।
- বিভিন্ন দেশ এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায় ।
- ঘরে বসেই ব্যবসায়-বাণিজ্য অর্থাৎ পণ্য কেনা-বেচা করা যায় ।
- টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে বিশ্বের নামকরা চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় ।
- ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে উপার্জন করা যায় । ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে ।
গ্লোবাল ভিলেজের অসুবিধাসমূহ (Disadvantages of Global Village):
- ইন্টারনেট হ্যাকিং করে তথ্য চুরি হয় এবং তথ্যের গোপনীয়তা প্রকাশ পায় ।
- অসত্য তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে ।
- জনগণ কোনো কিছু পড়ে এর সূত্র যাচাই না করে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারে ।
- নেটে বেশি সময় দেয়ার কারণে সত্যিকারের বন্ধুর চেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে পারে । এতে করে মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেতে পারে ।
- ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি । ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি হতে পারে ।
- পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হওয়া ।
- সাইবার আক্রমণ সংঘটিত হওয়া ।
- সহজে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে কোনো দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটা ।
- প্রযুক্তি বেশী ব্যবহারের ফলে শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হওয়া ।
- বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া ।
- পৃথিবীর কতিপয় বড় বড় তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার ফলে পৃথিবীর ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা ।